মিলন চন্দ্র দেবনাথ, নওগাঁ: দেশ স্বাধীনের দুই দিন পর ১৮ই ডিসেম্বর মুক্তির স্বাদ পান নওগাঁবাসী। তাই এই দিনকে ঘিরে নওগাঁয় হানাদার মুক্ত দিবস পালিত হয়েছে। সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘একুশে পরিষদ নওগাঁ’ এর উদ্দ্যোগে দিবসটি পালন করা হয়েছে। একুশে পরিষদ নওগাঁর ব্যানারে লেখা ছিল “নওগাঁ মুক্ত দিবস”। এর তাৎপর্যে বলা হয় ১৯৭১ সালের এই দিনে তৎকালীন নওগাঁ মহকুমা পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত হয়।
জাতীয় পতাকা এবং বিভিন্ন ফেস্টুন হাতে ১৮ই ডিসেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ তারিখ বুধবার সকাল সাড়ে ১০টায় শহরের মুক্তির মোড় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বর থেকে একটি বর্ণাঢ্য আনন্দ শোভাযাত্রা বের করে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে প্যারীমোহন লাইব্রেরী চত্বরে গিয়ে শেষ হয়। শোভাযাত্রাটির নেতৃত্ব দেন সংগঠনের সভাপতি অ্যাডভোকেট ডি.এম আব্দুল বারী। পরে সেখানে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এসময় সংগঠনটির সভাপতি এ্যাডভোকেট ডি.এম আব্দুল বারীর সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন সংগঠনটির প্রমুখ সদস্যবৃন্দ।
সেখানে উপস্থিত ছিলেন একুশে পরিষদ নওগাঁর উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ শরিফুল ইসলাম খান, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ প্রফেসর মুহম্মদ ওয়ালিউল ইসলাম, সাংবাদিক কায়েস উদ্দিন, অধ্যক্ষ সিদ্দিকুর রহমান, নওগাঁর প্রথম সংবাদ পত্রিকার সম্পাদক ও সাংবাদিক এস এম আজাদ হোসেন মুরাদ, সংগঠনটির সদস্য ও কলেজ শিক্ষক সাকিরুল ইসলাম রাসেল, মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম, মুক্তিযোদ্ধা এবিএম রফিকুল ইসলাম, নওগাঁ জেলা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক বেলায়েত হোসেন, জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার নওগাঁ জেলা প্রতিনিধি সাংবাদিক ওমর ফারুক, সংগঠনটির সাধারন সম্পাদক এম এম রাসেল, রোটানিয়ান চন্দন দেব, একুশে পরিষদ নওগাঁর সহ-সভাপতি নাইস পারভীন, সংগঠনটির সদস্য ও সাংবাদিক বিষ্ণু কুমার দেবনাথ, উপদেষ্টা বিন আলী পিন্টু, একুশে পরিষদ নওগাঁর সদস্য, স্কুল শিক্ষক ও সাংবাদিক মিলন চন্দ্র দেবনাথ, প্রদ্যুৎ ফৌজদারসহ সংগঠনের অন্যান্য সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানের শেষ প্রান্তে এসে একুশে পরিষদ নওগাঁর পক্ষ থেকে উপস্থিত তরুণ প্রজন্মের হাতে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা তুলে দেয়া হয়।
আয়োজকরা জানান- দেশ স্বাধীনের দুই দিন পর নওগাঁ হানাদারমুক্ত হয়। এই কথা আজকের তরুণ প্রজন্মের অনেকেই জানে না। প্রকৃত ইতিহাস তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতেই প্রতিবছর এই দিবসটি পালন করা হয়। উল্লেখ্য- ইপিআর ৭ নম্বর সেক্টরের অধিনে ছিলো নওগাঁ, জয়পুরহাট, দিনাজপুর, হিলি, নবাবগঞ্জ, রাজশাহী, পাবনা ও নাটোর অধিনায়ক ছিলেন- প্রথম দিকে ক্যাপ্টেন গিয়াস। পরবর্তীতে মেজর নাজমুল হক এবং তার মৃত্যুর পর মেজর নুরুজ্জামান। সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী মরহুম আব্দুল জলিল মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ পরিকল্পনা রচনা, তাদের ব্যয়ভার বহন ও রসদপত্র সরবরাহের বিষয়ে তত্বাবধায়ক ও সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন নওগাঁর দু’জন কৃতিসন্তান জালাল হোসেন চৌধুরী ও আখতার আহমেদ সিদ্দিককে সিএন্ডসি স্পেশাল প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ১৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনীরা ঢাকায় আত্মসমর্পন করার খবর শুনবার পরও নওগাঁর পাকবাহিনীরা অত্মসমর্পণ করবে না বলে ঘোষণা দেয়।
ফলে কমান্ডার জালাল হোসেন চৌধুরীর নেতৃত্বে পরদিন সকাল ৭টার দিকে প্রায় ৩৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা নওগাঁ শহরের দিকে অগ্রসর হন। ১৭ই ডিসেম্বর এক শীতের সকালে মুক্তিবাহিনী জগৎসিংহপুর ও খলিশাকুড়ি গ্রামে আসতেই পাকিস্থানী সেনারা ভারী অস্ত্র ব্যবহার করে। সকাল থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত উভয় পক্ষে প্রচন্ড যুদ্ধে ৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ১৮ই ডিসেম্বর শনিবার সকালে বগুড়া থেকে অগ্রসরমান ভারতীয় মেজর চন্দ্রশেখর, পশ্চিম দিনাজপুর বালুরঘাট থেকে পিবি রায়ের নেতৃত্বে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী নওগাঁয় প্রবেশ করলে হানাদার বাহিনীর আর কিছুই করার ছিলনা।
ফলে সকাল ১০টার দিকে প্রায় দুই হাজার পাকসেনা নওগাঁ কেডি স্কুল থেকে পিএম গার্লস স্কুল, সরকারী গার্লস স্কুল, পুরাতন থানা চত্ত্বর এবং এসডিও অফিস থেকে শুরু করে রাস্তার দু’পাশে মাটিতে অস্ত্র রেখে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে নতমস্তকে আত্মসমর্পণ করে। তৎকালীন নওগাঁ মহকুমা প্রশাসক সৈয়দ মার্গুব মোরশেদ মুক্তি বাহিনী ও মিত্র বাহিনীকে স্বাগত জানান। বর্তমান পুরাতন কালেক্টরেট (এসডি) অফিস চত্তরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। সেখানে উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধারা পতাকার প্রতি সালাম জানিয়ে সম্মান প্রদর্শণ করেন।