খোরশেদ আলম রাজু নওগাঁ প্রতিনিধিঃ শিল্প-সংস্কৃতি একটি জাতির চেতনাকে যেমন বহন করে তেমনি তার রুচি,মনস্তত্ব,বিশ্বাস,নীতিবোধ এবং আদর্শকে ধারণ ও রক্ষা করে।
রেষ্টুরেন্টে ভোজনের পাশাপাশি শিল্প সাহিত্যের ঘ্রাণ পাওয়া যায়, এমন দৃশ্য আমাদের দেশে খুব কমই লক্ষণীয়। তবে নওগাঁর পার্ক ভিউ রেষ্টুরেন্ট এর এমন ব্যতিক্রমী উদ্যোগে নজর কেড়েছে ভোজনরসিক তথা সৃজনশীল মানুষদের।
‘গাঁজা মহল’ নামে পরিচিত নওগাঁ। নানান ইতিহাসের ঝুড়ি মাথায় নিয়ে শহরের প্রাণকেন্দ্র মুক্তির মোড়ে আজও কালের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে একাধিক বৃটিশ স্থাপনা। সেখানে নওগাঁ জেলার সকল শ্রেণী পেশা মানুষের চলাফেরা হলেও অধিকাংশ শিক্ষার্থী ও শিল্প-সাহিত্য চেতনা সম্পন্ন মানুষের উঠাবসা লক্ষণীয়। এক পাশে পার্ক, অন্য পাশে বৃটিশ আমলের স্থাপনা, মাঝখানে পিচঢালা ভিআইপি প্রশস্ত রাস্তা,সেই রাস্তা সংলগ্ন সমবায় মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় পার্ক ভিউ রেষ্টুরেন্টের অবস্থান।
রেষ্টুরেন্টে বসে জেলা পরিষদ পার্কের সৌন্দর্য্য খুব সহজেই অবলোকন করা যাবে এমন চিন্তা থেকেই এই রেষ্টুরেন্টের নাম দেওয়া হয় “পার্ক ভিউ রেষ্টুরেন্ট” দৈনিক রূপালী বাংলাদেশকে এমনটায় জানিয়েছেন রেষ্টুরেন্টের স্বত্বাধিকারী দেশ টিভির প্রাক্তন অনুষ্ঠান প্রধান ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রবিউল করিম।
পার্ক ভিউ রেষ্টুরেন্ট আর দশটা রেষ্টুরেন্ট থেকে একটু ব্যতিক্রম। এর প্রতিটি দেয়ালে নিপুন হাতে শিল্পীর তুলির ছোঁয়ায় উঠে এসেছে প্রাচীন ও আধুনিক সংস্কৃতির এক অপরূপ মেলবন্ধন। বাঁশ, বেত আর গাছের গুড়ির সাথে প্রকৃতিক নানান গাছের সংমিশ্রণ এক অন্যরকম মায়াজাল বিস্তার করে ভোজনরসিকদের।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, ভারতীয় কবি জয় গোস্বামী, অন্যতম চিত্র শিল্পী গণেশ হালুই, ধীরাজ চক্রবর্তী, সংগীত শিল্পী আরতি মুখোপাধ্যায়, অজয় চক্রবতী আমাদের দেশের জনপ্রিয় কবি হেলাল হাফিজ, লেখক ও দার্শনিক সরদার ফজলুল করিম, ভাষা আন্দোলনে অন্যতম প্রাণপুরুষ ভাষা সংগ্রামী আব্দুল মতিন, আহমেদ রফিক সহ দেশী বিদেশী বিশিষ্ট কবি, সাহিত্যিক, চিত্র শিল্পী,সংগীতশিল্পীদের নিজহস্তে অঙ্কিত চিত্র, কথামালা, কবিতার পংক্তি সহ নানা বাক্যের সমাহার নিয়ে পার্ক ভিউ রেস্টুরেন্টে রয়েছে এক আট গ্যালারী। এই অমূল্য সাংস্কৃতিক দলিল সত্যিই বিরল। কেননা এসব কবি ও শিল্পী সাহিত্যিক অধিকাংশই জীবনের প্রথম স্বহস্তে আর্ট পেপারের উপর তুলির আঁচড়ে নিজেদের দৃশ্যায়িত করেছেন।
পার্ক ভিউ রেষ্টুরেন্ট শুধু আর্ট গ্যালারীতেই শেষ না। রেষ্টুরেন্টের এক পার্শ্বে রয়েছে প্রায় দুই শতাধিক বইয়ের লাইব্রেরী। যা জ্ঞান পিপাষু মানুষকে আন্দোলিত করবে। রেষ্টুরেন্টে প্রথম প্রবেশে যে কেউ একটু সংশয়ে পড়তে পারে। তবে কিছু পরেই ওয়েটারের দেওয়া খাবার তালিকা হাতে পাওয়ার পরেই নিশ্চিত হওয়া যাবে এটা একটা রেঁস্তোরা। রেষ্টুরেন্টের অন্দর ও বাহিরের এমন চিত্রাকর্ষক ডেকোরেশন যা কারো মন কেড়ে নিতে বাধ্য। রেষ্টুরেন্টের খাবারের মান ও আতিথিয়তায় মুগ্ধ নওগাঁবাসী। এখানে ছোটখাটো পাটি বা সেমিনার করারও সুব্যবস্থা রয়েছে।
পরিবার নিয়ে খেতে আসা ছোট বাবুদের খেলাধুলার জন্য বড় পরিসরে জায়গার ব্যবস্থা না থাকলেও অল্প পরিসরে বিনোদনের জন্য দোলনার ব্যবস্থা আছে। আর দোলনায় বসে কফি হাতে হালকা দোল খেতে খেতে খুব সহজেই জেলা পরিষদ পার্কের নয়নাভিরাম দৃশ্য উপভোগ করা যায়। রেষ্টুরেন্টে আসা প্রায় সকলেই এমন স্মৃতি ধরে রাখতে স্মার্ট ফোনে সেলফি তুলতে ভুল করেন না।
রেষ্টুরেন্টে খেতে আসা জেলা সাংবাদিক ইউনিয়ন নওগাঁর সাধারণ সম্পাদক ও সাহিত্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আশরাফুল নয়ন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন,একটি সমাজ,রাষ্ট্র বা পরিবার যখন অসুস্থ হয়ে পড়ে ঠিক সে সময় তাকে সুস্থ বা পরিবর্তন করতে কবি সাহিত্যিকের তীক্ষ্ম লেখনী শক্তিটা কয়েকটা ভারী বোমার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে যা অতীতে তাকালে আমাদের দেশসহ নানা দেশ প্রমাণিত। পার্ক ভিউ রেষ্টুরেন্ট হলো একটি খাবার জায়গা। জিহ্বায় খাবারের স্বাদের পাশাপাশি সাহিত্যের একটু নির্যাস যদি কেউ মগজে নিতে পারে তাহলেই সার্থকতা। রেষ্টুরেন্টে আড়ালে সাহিত্যের এমন দৃশ্য সত্যিই আমাকে মুগ্ধ করেছে, এর স্বত্বাধিকারী নিঃসন্দেহে একজন সাহিত্যেক মানুষ তাই এমনটা সম্ভব হয়েছে।
এনাম হক বলেন,আমি কয়েকটি দেশ ভ্রমণ করেছি রেস্তোরাঁয় নামীদামী আলোকসজ্জা সহ বিশেষ স্থান বা ব্যক্তির ছবি দেখেছি কিন্তু এমন সাহিত্যিক দৃশ্য আমার চোখে পড়েনি এটা নিঃসন্দেহে একটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগ।
রেষ্টুরেন্টের সাথে এমন দেশ বরেণ্য শিল্পী সাহিত্যিক,লেখক ও দার্শনিকের লেখনী কেন এবং কিভাবে সংগ্রহ করলেন এমন প্রশ্নের জবাবে পার্ক ভিউ রেষ্টুরেন্টের স্বত্বাধিকারী দেশ টিভির প্রাক্তন অনুষ্ঠান প্রধান ও সাহিত্যিক রবিউল করিম দৈনিক রুপালী বাংলাদেশকে বলেন,আমি দীর্ঘ সময় ধরে গণমাধ্যমের সাথে যুক্ত ছিলাম সে সুবাদে পেশাগত কারণে হলেও এক সময় ব্যক্তিগত ভাবে এসকল মানুষদের সাথে একান্ত সুসম্পর্ক হয়। মানুষতো চিরকাল বাঁচে না, বেঁচে থাকে তার কর্ম। এইসব বিখ্যাত মানুষগুলোকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করার ভাবনা থেকেই এই মাধ্যম বেছে নেয়া। রেষ্টুরেন্টে এগুলো প্রদর্শন করার একটাই কারণ বা উদ্দেশ্য সেটি হলো,একজন লেখক,কবি, শিল্পী সাহিত্যিকরাই পারে ঝিমিয়ে পরা রাষ্ট্র বা সমাজকে জাগিয়ে তুলতে। রেষ্টুরেন্টে খেতে আসা কেউ যদি এই ধরনের দৃশ্য অবলোকনে সামান্য অনুসন্ধিৎসু হন, ব্যক্তিটিকে জানতে বা পড়তে একটু উদ্বুদ্ধ হন তাহলেই সার্থকতা। পেটের ও মগজের ক্ষুধা দুটোকেই যদি আপনি নিবারণ করতে পারেন তবেই না আপনি সত্যিকারের ক্ষুধানিবারকের ভূমিকায় যেতে পারবেন। পার্ক ভিউ রেষ্টুরেন্ট সেই চেষ্টাটায় করে যাচ্ছে।